‘ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে।’
ভালোবাসার কাঙাল ছিলেন তিনি। যখন মাঠে নামতেন----
যশ নয়, খ্যাতি নয়, অর্থ নয়, এমনকী জয়ও নয়! শুধু শিশুর মতো, সৃষ্টির, নূতনের আনন্দ পেতে চাইতেন। বাঁ
পায়ের ছোট্ট হাফ-টার্নে একজন শুয়ে পড়ত। পরের বলিষ্ঠ টান দিত বাধ্য ডান পা। কোনো এক
অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা চামড়ার গোলকটি মালিকের ইচ্ছাধীন হয়ে সামান্য দূরে সরে যেত, প্রতিদ্বন্দ্বী ডিফেন্ডারের
ছোঁয়া এড়িয়ে। যখন মাঠে নামতেন,
গেরুয়া
ধুলোর ঝড় তাঁর পাঞ্জাবি, উসকো-খুসকো দাড়ি, চশমার ফ্রেমে লেগে যেত। কানের
কাছে ফিসফিসিয়ে বলত, ‘আমাদের কথা বলো।
আমাদের সঙ্গে কথা বলো, হে উদাসী রাজকুমার!’
কত সহজে বুঝেছিলেন, শৃঙ্খলা শব্দটি আসলে শৃঙ্খলের একটি রূপ মাত্র। সে জিনিস
কখনো স্বাধীন মানুষের জন্য নয়। তিনি তো রাজত্ব গড়তে চাইছেন না, যে রাত জেগে পাতার পর পাতা
সুশৃঙ্খল কাহিনি বুনে যেতে হবে তাঁকে, বা দীর্ঘ অনুশাসিত জীবনে এক সিংহাসন থেকে অন্য সিংহাসনে ছুটে যাবে তাঁর
দাসত্ব-জীবন!
তিনি কবি। তিনি উচ্চণ্ড! তিনি খ্যাপা ঝরনার মতো
বেনিয়ম। আগলহীন! সুন্দর!
এক মুহূর্তে তিনি শুকনো পাতায় মোড়া জঙ্গলের
রাস্তায় হেঁটে যান নিজের ঋজু ছায়াকে পিছনে ফেলে---- পরমুহূর্তে তিনি গর্বিত পেশিতে
এঁকে নেন বিপ্লবীর মুখ। এক দিগন্তে তিনি হেরে যাওয়া, মাঝারি মানুষদের তুলে নিয়ে আসেন অনন্য উচ্চতায়---- অন্যতর
ভূগোলে তিনি মানুষের ভিড় থেকে সরিয়ে নেন নিজেকে। চাইলেই তিনি বজ্রনির্ঘোষে গেয়ে
ওঠেন অতল খাদ কাঁপানো গান। চাইলেই তিনি মুহূর্তের জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় ম্লান করে দেন
লক্ষ মানুষের রাতজাগার ক্লান্তি।
কখনো তিনি লিখবেন----
‘বেরিয়ে পড়ো হাওয়ায় ও যে পায়ে পড়ছে এসে
এমন রাতে ঘুম ভাঙাতো স্বপ্নাতুর চোখ
ঘরের ভিতর হাওয়া খেলতো আলুল কালো কেশে
ফুটে উঠতো ফুলের বাগান, যেতে হতো না।’
কখনো তিনি পাথর থেকে পাথরের বুকে উচ্ছল নাচতে
নাচতে একটি চৌকোণা পুরুষ-গন্ধী মাঠে ছড়িয়ে দেবেন হংসধ্বনির সুললিত সুর।
কখনো তিনি হিংস্র বুটের ডগায় রক্তাক্ত হতে হতেও
ক্ষাত্র-তেজে উঠে দাঁড়াবেন এবং বিপক্ষের চোখে চোখ রেখে, অপরাজিত দুর্গের সূক্ষ্মতম ছিদ্রে নিজের শাণিত আক্রমণ
কেন্দ্রীভূত করে বলবেন, ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?’
তিনি এমনিতে কোথাও বাঁধা পড়েন না। যদি একান্তই
কেউ খুঁজতে চায়, তাহলে প্রতিষ্ঠানের
মঞ্চে নয়, ঠিক তার পাশে
ধুলোমাখা গাছতলায় তাঁকে পাওয়া যাবে। শরীরে চে গ্যেভারাকে ধারণ করে কি আর
প্রাতিষ্ঠানিক হওয়া যায়?
হে ধীমান, আপনি বলতেই পারেন, মারা গেছেন একজন লাতিন
আমেরিকান ফুটবলার। এই বই তো নয়। হ্যাঁ, একটা বিশ্বকাপ জিতেছে। সে তো ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা মিলিয়ে আরো শ’দেড়েক লোক জিতেছেন। একই দেশের
পাসারেল্লা তো দু’ বারের বিশ্বকাপ জয়ী দলেরই সদস্য। কিন্তু ভুলে গেলে তো চলবে
না---- এই লোকটা কোকেন নিয়েছে। ধরা পড়েছে। বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে ড্রাগ
নেওয়ার অপরাধে।
মৃত্যু মাত্রেই দুঃখজনক। তা বলে একজন
ড্রাগ-অ্যাবিউজার, ওবেসিটিতে ভোগা
প্রাক্তন স্কিলড প্লেয়ারের ওবিচুয়ারি লিখতে বসে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা এনে, হিন্দুস্তানি মার্গসংগীতের
গুষ্টির তুষ্টি করে এই ধ্যাষ্টাপনাটা কি না করলেই হচ্ছিল না?
হ্যাঁ, আপনি বলতেই পারেন।
আমি, আমরা--- যারা মনে মনে নিজেদের পাঁচ-ছ-আট-দশ বছর বয়সে ফিরে গেছি এখন----
আমরা যারা সাদা-কালো পোর্টেবল টিভির সামনে অধীর আগ্রহে বসে পড়েছি, তারা সেসব শুনতে পাচ্ছি না।
এখন আমরা সাদা-নীল ডোরাকাটা জার্সিতে, ঝাঁকড়া চুলের যাকেই দেখছি,
বাবা-কাকা-মামাদের
জিজ্ঞাসা করছি এই কি সে? এই কি সে?
অবশেষে ‘সে’-কে দেখতে পাচ্ছি।
অনায়াসে চামচে করে আইসক্রিমের স্কুপ তোলার চেয়েও সহজে বল তুলে নিচ্ছেন ভ্যাবচ্যাক
ডিফেন্ডারের পা থেকে। সরল হাসিটি মুখে রেখে, অপরূপ বন্য লাবণ্যে এগিয়ে চলেছেন বিপক্ষের প্রতিরোধ ফালা
ফালা করে।
আপনারা বলছেন বলুন, তবে স্বয়ং নটরাজ যখন পায়ে বাঁধা অদৃশ্য নূপুরে অশ্রুতপূর্ব
ঝংকার তোলেন---- তখন কি আর অন্য কথা কানে যায়?
আপনি পণ্ডিত মানুষ। সুশৃঙ্খল পেলে তাঁর অল-রাউন্ড
ফুটবল এবিলিটি নিয়ে আপনার মাথায় থাকুন। একসূত্রে গাঁথা জার্মান দল তাঁদের একাগ্রতা
দিয়ে ছিনিয়ে নিক আপনার সশ্রদ্ধ অভিবাদন। আপনি তারিফ করুন আয়ুষ্মান শীর্ষেন্দু ও
সুনীলের বহুমুখিতার।
শ্রীজাত লিখেছেন আমরা শাক্ত। আজ শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। শাক্ত তো বটেই। সেই সঙ্গে, আমরা বাঙালিরা দিয়েগোয়ানও বটে। দেখছেন না, ফুটবল নিয়ে লিখতে গিয়ে কবিতা
লিখে ফেলি, আর কবিকে নিয়ে লিখতে
গিয়ে ড্রিবলের কথা! শৃঙ্খলা,
নিয়ম-নীতির
বিন্দুমাত্র বালাই নেই যেন!
আমরা হেরে যাওয়া, থেঁতলে যাওয়া, সাব-অল্টার্ন! আমাদের জন্য এলোমেলো, উদ্দাম, বেখেয়ালি শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ই ভাল। আমাদের বুকে বেপরোয়া, উশৃঙ্খল, উদাসীন রাজপুত্র
দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনারই বাস।
আজ দিয়েগো মারাদোনার প্রয়াণদিবস। আজ আনন্দ উদযাপন
করার দিন।
মারাদোনা মারা যাননি। যেতে পারেন না।
আসুন, আমরা সেই ফেনিল আনন্দপুরুষের জীবন উদ্যাপন করি।
‘ফিরেছি, তোমায় দেখবো, তোমায় দেখতে পাচ্ছি
হয়তো তোমায়; স্ফটিক-জলের মতন বেঁকানো;
কানের পাতার তল বয়ে ওড়ে চুলের গুচ্ছ,
তোমার আলোই তোমায় মধুর করেছিল একা।’
পুনশ্চ: এই লেখায় ব্যবহৃত সমস্ত পদ্য শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের লেখা। আর এই খেলায় রেখে যাওয়া সমস্ত পদ্য লিখেছেন দিয়েগো আর্মান্দো
মারাদোনা!
Recent Comments: