দুয়ারে বসে আছে শীতকাল, বিগতযৌবনা, এলোচুল ধূলায়
মলিন, শ্রীঅঙ্গের বসনখানি জীর্ণ, তবুও তার
ভুবনডাঙায় থেকে যাওয়ার বাসনা যায় না। মুখে বলিরেখার দাগ, কপালে
সিন্দুর নাই, স্বামী গত হয়েছে দুই শত তিন শত বৎসর পূর্বে, এখন তার
সাধ হয়েছে পুতির মুখ দেখার। গ্রামদেশের লোকে বলে, সুদের
সুদ! নাতি হল সুদ আর তার পোলা সুদের সুদ,
দীর্ঘ পরমায়ুর ভাগ্যি না থাকলে তাকে দেখা যায় না।
আমি একটু এগিয়ে এসে মুখ নীচু করে বললাম, ঠাকরোণ, এবার যে
যেতে হবে!
কানে কিছুই শোনে না, মোলায়েম
রোদ্দুর ফুটেছে সকালে, চুপ করে বসে আছে। এবার একটু চেঁচিয়েই বললাম। মুখ
তুলে তাকাল আমার দিকে। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল
----চাট্টি গুড়মুড়ি দ্যা না বাপ!
----গুড়মুড়ি?
----ডাগর ডোগর মুড়ি, আখের গুড়, দ্যা না
বাপ, বগুপারা বাটি করে খাই! মুখে স্বাদ নাই, খাই!
----আমি কি মুড়ির টিন নিয়ে বসে আছি? অনেকদূরের
পথ, বেলাবেলি যেতে হবে, চলো চলো!
ওঠো!
----কোনঠি যাবি, বুড়া
হইছি, কোনঠি নে যাবি, হাগামুতার
বশ নাই, কোনঠি নে যাবি বাপ?
নাহ! শীতবুড়ি তো জ্বালাল দেখছি। হাতের ড্যাঙশখানি
দেখিয়ে বললাম
----দেখেছ? পিঠে এবার
এই ড্যাঙশ পড়বে! চলো বলছি, বৈতরণী পার হওয়ার ম্যালা হ্যাপা, চলো চলো, তা না
লাটের বাট গুড়মুড়ি খাবে এখন!
----দ্যা না বাপ, কী দেলি
জেবনে, বল!
----মহা নিমকহারাম তো, দিইনি, অঘ্রানের
মতো বর বর্ষালতার মতো বিটি ভরভরন্ত সংসার, দিইনি?
----হঃ, উসব কুন
কাজের! পীরিত, পীরিত দেলি?
মুরোদ কত,
হঃ, পিরীত দেতি পারে নাই, আবার
সোমসার পাতি দেছে!
বুড়ির গলায় বোল ফুটেছে। পীরিতের কথা শুনে মুখ
ব্যাজার করে দাঁড়িয়ে থাকি। গম্ভীর গলায় বলি
----ওসব পীরিত ফিরিত আমার হাতে নাই!
----তাইলে কী মরতে নিতি এসছিস ড্যাকরা!
----শরীর পুরাতন হয়েছে, ফেলে
দিয়ে ‘মাল’ নতুন শরীরে ভরে দিতে হবে। তেমনই আদেশ, তাই এসেছি!
----উঃ, গতরখেকো
মিনসে এসছে, সখ কত!
----আমি গতর খাই না, ও
হব্যবাহর কাজ!
----সে আবার কোন্ মিনসে? আন্ তো
দেখি, বিষ ঝেড়ে দেবনি!
এসব কথায় আর ভুলি না এখন। সুর নরম করে বললাম, বিড়ি
খাবা?
----দ্যা, বিড়িই
দ্যা একখান! খাই!
ফসফস করে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ছে বুড়ি। আমের নতুন বোল
এসেছে, দু-একটি ভ্রমর উড়ছে বাতাসে, দুটি
শিরীষ গাছ আছে উঠানের ওদিকে, যুবতি বোষ্টুমির মতো ডালে ডালে খঞ্জনি বাজাচ্ছে তারা।
সজিনার ডাঁটাগুলি সরু সরু এখন, আর ক’দিন পরেই গায়েগতরে হবে, তারপর
হলদে মতো, বিচিগুলো ফেটে ছড়িয়ে পড়বে চরাচরে, বাতিল
খোলসদের নিয়ে যেতেও নিশ্চয় কেউ আসবে সেই সময়। আজ সকালে, আলো ফোটে
নাই, আকাশে জ্বলজ্বল করছে বৃশ্চিকমণ্ডলী, অভিজিৎ
নক্ষত্র, আমি বায়ুবন্ধন করে নেমে আসছিলাম, শুনলাম
দুটি কোকিল পরস্পরকে কী মধুস্বরে ডাকছে। নশ্বর মানুষ মানুষীর জগতে মধুঋতু আসছে।
বুড়ি এখন অনেক টালবাহানা করবে, দেহী কে
নিয়ে যেতে সেই চতুর্থ প্রহর, জানি আমি। ত্রিপাদ দোষ পাবে এই মৃত্যু, তেমনই
গণনা স্থির করা আছে।
তার আগে কেঁদে আকুল হবে দেহ, দেহী
নির্বিকার যদিও।আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি,
ত্রিবেণীর ঘাটে স্থির বসে আছে এক যৌবনবতী রমণী, এই বুড়ি
শীতকালের পূর্বজন্ম। ওঁর নাম অহল্যা ডোমনি। ওই যে পীতবসনা হেঁটে চলেছে সদর
স্ট্রিটের দিকে, বেতফলের মতো দুটি চক্ষু খোলা চুলে সমুদ্র খাঁড়ির
গর্জন, নীলাঞ্জনা,
আরেকটি জন্ম। একটু দূরে চঞ্চলা নদীর মতো নৃত্যরতা ওই
বোষ্টুমি, অন্য এক জন্মের আখ্যান। সবাইকে চিনি আমি।
সবাই বড় বিষাদগ্রস্ত, চোখের জল
শুকিয়ে গেছে, সবাই কতবার চেয়েছে পীরিত! কেউ তাদের ভালোবাসেনি, অপ্রেমের
যন্ত্রণায় শুকিয়ে গেছে যত হৃদয়কুসুম,
বারবার বলেছে আমাকে, একটু ভালোবাসা
দাও। মিনতি করেছে হাত জোড় করে।
হায়! কী করব আমি। আমি যে নর দেব যক্ষ গন্ধর্ব প্রেত
পিশাচ কিছুই নই। আমি ব্যাখ্যাতীত একটি ভাব মাত্র। শত শত বৎসর অযুত নিযুত কোটি লক্ষ
বৎসর ধরে দূর নীহারিকার সৃষ্টিলগ্নে এই প্রকাণ্ড ব্রহ্মাণ্ডে আমি আত্মগোপণ করে
আছি। আমার দেহ নাই আকার নাই হৃদয় নাই আমি জড় নই জীবনও নই, সকল জীবের
হৃদয়ে আমি তার স্ব-ভাব হয়ে ফুটে উঠি। জলের মতো। সেইখানে প্রেম থাকলে আমিই প্রেম, ঘৃণা
থাকলে আমি তীব্র হলাহল।
Recent Comments: