প্রাদেশিক
স্পেশাল
পর্ব: ৩
নাহ্!
এত তাড়াতাড়ি মহারাষ্ট্র ছাড়া যাবে না বুঝলেন! গত পর্বে মারাঠি স্টাইলের পোহা খেয়ে ঝপ করে অন্য
স্টেটে লাফ দেওয়াটা ঠিক হবে না। যদিও রিজিওনাল স্পেশাল তবুও একই রাজ্যে আরো একদিন
জমিয়ে বসতে ইচ্ছে করছে। পেটে বেশ খানিকটা জায়গা এখনও বাকি তাই দু-চারটে
মহারাষ্ট্রিয়ান খাবারদাবার না হলেই নয়। কিন্তু ডান হাতের কাজ শুরু করার আগে চলুন
সবাই মিলে সিদ্ধি বিনায়কে একটু ঢুঁ মেরে আসি। এবার মনে করুন যে আপনি বেশ
শুদ্ধচিত্তে ভক্তিভরে পুজো দিয়ে দর্শন সেরে বাইরে বেরোলেন। দেখলেন বেলা গড়িয়েছে।
পেটবাবাজি কেমন গাঁইগুঁই করছে। কী
খাব, কী খাওয়া যায় বলে যখন পথ হাতড়াচ্ছেন
তখনই হঠাৎ ধাঁ করে একটা কথা মগজে ল্যান্ড করল, খালি পেটে ধর্ম হয় না। শুধু ধম্মো
কেন মশাই কোনো কম্মোই হয় না। সুতরাং পেটপুজো দরকার কিন্তু কী খাওয়া যায়?
অমুক
পুজো বা তমুক রাত্রির জন্য বছরে কিছু না কিছু উপোস তো করেই থাকি আমরা, তারপর
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে উপোসভঙ্গে মিষ্টি কিছু মুখে দিতে হবে ভাবলেই মুখটা কেমন
টোকো হয়ে যায়। আর তখনই যদি রান্নাঘরের থেকে ভোগ বানানোর তেল-মশলা কষানোর বেশ একটা জিভে জলআনা
খুশবু উড়তে উড়তে নাকে আসে, তখন আলপনা দিতে দিতে পেটের কোনায় হঠাৎ এক চিলতে খিদে বুড়বুড়ি কেটে আবার মিলিয়ে যায়। চুপিচুপি
একটা ঢোক গিলে ভাবতে বসেন, কতদূর
আর কতদূর বলো মা... কিন্তু একথা
একেবারে সত্যি যে উপোসের ঠিক পরেই নোনতা বা ঝাল কিছু খাবারের জন্য মনটা আকুপাকু
করে। পুজো শেষে কার আর মিষ্টি খেতে ভালো লাগে! অথচ হয় সেই ফল-মিষ্টি নচেৎ সেই দুধ-সাবু খেতে হয়। ধ্যাত্ ভাল্লাগে না। কেবিসি’র
মতো বেশ কিছু উপোসের খাবারের অপশন পেলে ভালো হত।
কেবিসি’র
মতো চারটে কেন আপনি ছ-সাতটা অপশন তো হেসেখেলে আরামসে পেতেন যদি আপনি পশ্চিম বাংলার
বাসিন্দা না হয়ে উত্তর ভারত বা পশ্চিম অথবা মধ্যভারতের বাসিন্দা হতেন। এখানে উপোস
বা ফাস্টিং-এর সময় অনেক
রকম খাবারদাবার বানানো হয় যাকে ব্রত-রেসিপি বা ফাস্টিং রেসিপিও বলা হয়। তাতে
সিঙ্গারা আটা দিয়ে বানানো পুরি (মানে বাংলায় যাকে পানিফল বলে তার আটা) সবজি থেকে
শুরু করে সাবুদানা টিক্কি, সাবুদানা বড়া, সাবুদানা চিলা, সাবুদানা দিয়ে উপবাসচে্
থালিপেঠ, সাবুদানা ক্ষীর, মখানার শাহী ক্ষীর, কুরকুরে আলু কে পকোড়ে... উফ্ আরো কত কী! বলতে বলতে হাঁফ ধরে গেল। পড়ে
বুঝতেই পারছেন ব্রত-রেসিপিগুলোর মধ্যে সাগু বা সাবুদানা অলরেডি একটা গুরুত্বপূর্ণ
জায়গা দখল করে বসে। পুণে, ইন্দোর, নাগপুর, ভোপাল, জয়পুর এবং মুম্বইয়ে কিন্তু
সাবুদানা বড়া এবং সাবুদানা খিচড়ি স্ট্রিট ফুড হিসেবেও পাওয়া যায়।
সাধারণত
উত্তর, পশ্চিম ভারত তথা মধ্যভারতে নানান সম্প্রদায়ের মানুষেরা নবরাত্রি (Navratri) পালন করেন। পুজোর
যে ন’দিন বাঙালিরা বিরিয়ানিতে কবজি
ডোবায় তখন এঁরা আমিষ
বিসর্জন করে সাত্ত্বিক আহারে মন দেন। তার কারণ হল পুজোর সময়টা সিজন চেঞ্জের সময়। তাই
শরীরের বিশেষ খেয়াল রাখতে আধ্যাত্মিক শুদ্ধিকরণের পাশাপাশি সবাই রসুন, পেঁয়াজ এবং
সমস্ত আমিষ খাবার থেকে বিরত থাকেন এই ন’দিন। ফল, ড্রাই ফ্রুট্রস এবং অন্যান্য সহজপাচ্য নিরামিষ পদ খান। তাতে শরীর সুস্থ থাকে ও
হজমের গোলমাল হয় না। নবরাত্রির
ন’দিনের খাবারের পেছনে এটি হল বিজ্ঞানসম্মত কারণ। তা সেই সময় যেসব ফাস্টিং ফুড
খাওয়া হয় তার মধ্যে সাবুদানা একটি অন্যতম খাবার যা সবাই বড় ভালোবেসে খান। সাবুদানাতে
কার্বোহাইড্রেট থাকে, তার ফলে
উপোসের পর খেলে ভরপুর এনার্জি পাওয়া যায় আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল সাগু বা
সাবুদানার বৈচিত্র্য। সাবুদানা
থেকে এত রকমের খাবার খুব সহজেই বানানো যায় যে সত্যি অবাক হতে হয়। এবার বুঝলেন তো
কেন বলছিলাম মহারাষ্ট্রতে আরো ক’দিন থাকার কথা। উপোস করুন বা না করুন, ক’টা
সাবুদানার রেসিপি শিখে রাখতে ক্ষতি কি! পরের বার হয় ব্রেকফাস্টে বা বিকেলে চায়ের সঙ্গে অথবা
উপোসের অপশন হিসেবে দিব্যি বানিয়ে নিতে পারেন সাবুদানা দিয়ে এই মুখরোচক খাবারগুলি।
এই পর্বে রইল পরপর তিনটে রেসিপি যার মূল উপকরণ: সাগু বা সাবুদানা।
সাবুদানা
খিচড়ি /Sabudana
Khichri ( মারাঠি
স্টাইল )
উপকরণ:
১। বড়দানার সাবু- ১ কাপ
২। আলু-
১ টা মাঝারি সাইজের ডুমো করে কাটা
৩। মুগফলি
বা চিনেবাদাম- মোট ৫ চা চামচ
(৪
চামচ রোস্টের জন্য আর ১ চামচ ফোড়নের জন্য)
৪। গোটা
জিরে- ১/২ চা চামচ
৫। সৈন্ধব
লবণ (উপোসের জন্য) নইলে সাদা নুন- স্বাদমতো
৬। ঘি
(উপোসের জন্য বানালে ঘি) অথবা সাদা
তেল- ২ চা চামচ
৭। কারিপাতা
ও ধনেপাতা- আন্দাজমতো
৮। কাঁচালঙ্কা
কুচি- ১-২ টো
৯। লেবুর
রস- ৩ চা চামচ
টিপস:
১। সাবুদানাতে
যেহেতু স্টার্চের মাত্রা বেশি থাকে তাই ভালো করে দু-তিন বার
চটকে ধুয়ে নেবেন তাতে স্টার্চের মাত্রা কমে যায় যার ফলে সাবুদানা খিচড়ি বানানোর
সময় চিপকে যাবে না।
২। নন-স্টিক
কড়াই ব্যবহার করুন।
৩। চিনেবাদাম
রোস্ট করে সেটা গুঁড়ো করে সাবুদানাতে অবশ্যই মেশাবেন তাতে স্বাদ ও বাড়বে এবং সাবু
ঝুরঝুরেও থাকবে।
পদ্ধতি:
বড়দানার সাবু/সাগু ভালো করে ধুয়ে ছড়ানো বাটিতে ১:১ অনুপাতে জল মিশিয়ে ঢাকা লাগিয়ে সারারাত রেখে দিন। সারারাত বললাম কারণ কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা লেগে যায় সাবুদানা ভালো করে ভিজতে। পরের দিন সকালে দেখবেন সব জল শুষে নিয়ে সাবুদানা ফুলে দ্বিগুণ সাইজের হয়ে গেছে এবং ঝুরঝুরে রয়েছে। জল মেপে না দিলে সাবুদানা ঝুরঝুরে হবে না। দু’ আঙুলে চাপ দিলে দেখবেন সুন্দর নরম হয়ে ভেঙে যাবে। তার মানে একদম পারফেক্টলি রেডি।
এবার খালি কড়াইতে চিনেবাদামগুলো ভালো করে সময় নিয়ে রোস্ট করে একটা পাত্রে নামিয়ে রাখুন। ঠান্ডা হলে চিনেবাদামের খোসা ছাড়িয়ে বা খোসাসহ মিক্সিতে পিষে নিন। এবার চিনেবাদাম গুঁড়ো বা পাউডারটা, সাবুদানাতে ভালো করে মিশিয়ে দিন। এতে সাবুদানার উপর একটা কোটিং লেগে যাওয়ায় সাবুদানা একে অপরের সঙ্গে আটকে না গিয়ে বেশ ঝুরঝুরে হবে। প্রায়শই অভিযোগ আসে সাবুদানা খিচড়ি বানাতে গিয়ে গায়ে গায়ে আটকে ঢেলা পাকিয়ে যাচ্ছে, কী করব? এই টিপস ফলো করুন, দেখবেন সমস্যা হবে না।
এবার নন স্টিক কড়াইতে ঘি/তেল দিন। গরম
হলে গোটা জিরে, কিছু কারিপাতা ও কাঁচালঙ্কা কুচি ফোড়ন দিন। ফোড়ন থেকে সুন্দর গন্ধ
বেরোলে ডুমো করে কেটে রাখা আলু ও বাকি কাঁচা চিনেবাদামটা দিয়ে দিন। নেড়েচেড়ে ঢাকা
লাগান। খানিক পরেই আলুগুলো বাদামি হয়ে গেলে বুঝবেন সেদ্ধ হয়ে গেছে, এবার স্বাদমতো
নুন মেশান। উপোসের জন্য বানালে ঘি এবং সৈন্ধব নুনের ব্যবহার করুন। এরপর চিনেবাদাম
গুঁড়ো মেশানো সাবুদানাগুলো কড়াইতে তুলে দিন। আঁচ কম করে ভালো করে টস করুন বা
মিশিয়ে নিন। লেবুর রস দিন। একটা কাঁটা চামচ দিয়ে তা মিশিয়ে দিন সাবুদানার সঙ্গে। কাঁটা
চামচ বললাম কারণ হাতা দিয়ে মেশাতে গেলে সব ঘেঁটে ড্যালা পাকিয়ে যেতে পারে। সাবুদানা
দেওয়ার পর বেশিক্ষণ কড়াইতে
নাড়বেন না। তাতে সাবুদানা গায়ে গায়ে চিপকে স্টিকি হয়ে যাবে। অনেকে অল্প চিনি দেয়
তবে সেটা একান্তই আপনার পছন্দ। সাবুদানা ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে
দিলেই সাবুদানা খিচড়ি রেডি। নামাবার আগে নুনটা দেখে নেবেন। উপোস ছাড়াও রোজকারের
জলখাবার হিসেবেও বানিয়ে খেতে পারেন।
সাবুদানা বড়া /Sabudana Vada (মারাঠি স্টাইল )
এটি একটি অথেনটিক মারাঠি স্ন্যাকস এবং জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড হিসেবেও বিখ্যাত। হ্যাঁ, সাবুদানা বড়ার কথা বলছি। উপরোক্ত সব উপকরণই এক কিন্তু এবার পরিমাণ বদলাবে। এখানে এক কাপ সাবুদানার সঙ্গে লাগবে ৪-৫ টা মাঝারি মাপের সেদ্ধ করা আলু। মানে আলু বেশি সাবুদানা কম। ঠিক সেই একই ভাবে সাবুদানা ভিজিয়ে, তাতে সেদ্ধ করে রাখা আলু, ৬-৭ চা চামচ রোস্টেড চিনেবাদাম গুঁড়ো (খোসাসহ বা খোসা বাদে), ১ চা চামচ গোটা জিরে, পরিমাণ মতো কাঁচালঙ্কা ও ধনেপাতা কুচি, স্বাদমতো নুন, ১/২ চা চামচ চিনি, ২ চা চামচ লেবুর রস ও অল্প পরিমাণে আটা মেশান। উপোসের জন্য বানালে কুট্টু কে আটে অথবা সিঙ্গারে কি আটা ব্যবহার করবেন নচেৎ এমনি খেলে চালের আটা মানে চালের গুঁড়ো মেশাতে পারেন। এখানে চালের গুঁড়ো বা আটা বাইন্ডারের কাজ করে নইলে অনেক সময় সাবুদানা বড়া ভেঙে যেতে চায়। সব কিছু ভালো করে চটকে মেখে নিন। এরপর মিশ্রণটি থেকে লেচি কেটে দু’ হাতের সাহায্যে গোল গোল মাঝারি সাইজের বড়ার আকারে বানিয়ে নিন। বড়াগুলায় অল্প চাপ দিয়ে একটু চ্যাপ্টা করে নিন। এতে ভালো করে ভাজা হবে ও মুচমুচেও হবে। সব বড়া বানিয়ে সাদা তেলে বাদামি করে ভেজে নিলেই তৈরি সাবুদানা বড়া। মাঝারি আঁচে ভাজবেন নইলে ভেতরটা ভালো করে ভাজা হবে না। সাবুদানা বড়া খেতে বাইরেটা মুচমুচে আর ভেতরটা নরম। টমেটো সস বা ধনিয়া পুদিনার চাটনি সহযোগে পরিবেশন করুন। এসবের সঙ্গে চা-টা কিন্তু মাস্ট।
সাবুদানা
ক্ষীর
উপকরণ:
ভেজানো
সাবুদানা- ১ কাপ
দুধ-
১ লিটার
কনডেন্স
মিল্ক- ১/২ টিন
চিনি-
স্বাদমতো
জাফরান-
অপশনাল
এলাচ
গুঁড়ো - ১/২ চা চামচ
ড্রাই
ফ্রুটস- পছন্দ মতো
পদ্ধতি:
চালের
পায়েস বা ক্ষীর বানাতে অনেক সময় লাগে কিন্তু সাবুদানা ভেজানো থাকলে এটা বানাতে খুব
অল্প সময় লাগে। একইভাবে সাবুদানা ধুয়ে রাতভর বা কমপক্ষে ঘণ্টা পাঁচেক ভিজিয়ে রাখুন।
দুধ ফুটতে শুরু করলে আঁচ অল্প করুন। ফুটে ঘন হয়ে পাঁচশো মিলি মতো হয়ে এলে তাতে
ভিজিয়ে রাখা জল ঝরানো সাবুদানাগুলো দিয়ে দিন। মিডিয়াম আঁচে নাড়তে থাকুন নইলে
সাবুদানা নীচে আটকে যাবে। সাবুদানা যতক্ষণ না পর্যন্ত সেদ্ধ হয়ে ট্রান্সলুসেন্ট
মানে সাদাটে ভাবটা চলে গিয়ে দানাগুলো স্বচ্ছ হয়ে আসবে ততক্ষণ দুধে সেদ্ধ হবে। দু-একটা সাবুদানা তুলে আঙুল দিয়ে চিপে
দেখলে বুঝবেন গলে যাচ্ছে। তার মানে সাবুদানা সেদ্ধ হয়ে গেছে। এবার মিল্কমেড মিশিয়ে
দিন। মিষ্টির পরিমাণ দেখে নিয়ে দরকার মতো চিনি মেশান। যদি কেশর বা জাফরান মেশাতে
চান তাহলে চার-পাঁচটা কেশরের স্ট্যান্ড এখন দিয়ে দিন। দুধের
কালার হলুদ হয়ে যাবে, ফ্লেভারও ভালো হবে, তবে
এটি অপশনাল। দুধ ঘন হয়ে আসতে শুরু করলে এলাচ গুঁড়ো ছড়িয়ে আঁচ বন্ধ করুন। সাবুদানা
ক্ষীর তৈরি। ঠান্ডা হলে আরো ঘন হয়ে যাবে তাই সেই বুঝে নামাবেন। ক্ষীর/পায়েস ঠান্ডা
হলে ওপরে বাদাম বা পেস্তা ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।
সামনে
পুজো আসছে, একটু-আধটু উপোস
করতেই হবে তাই রেসিপিগুলো ট্রাই করতে পারেন। মতামত জানাতে ভুলবেন না। সবাই ভালো
থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
Recent Comments: