বর্ষা এলেই বাঙালির কাব্যগুণ কাঠঠোকরার মতো ঠুক ঠুক করবেই কাগজে
বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কের স্ট্যাটাসে। মন্দ
কী? প্রতিভার অন্বেষণ ঘটুক। ছিট ছিট গোলাকৃতি পাতাবাহারে কয়েক কণা জলবিন্দু টলমল করলেই ‘গ্রাম
ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ’ পেরিয়ে মন পদ্মপুকুরে ঝাঁপ দেবেই। এমন না হলে এই মনের তাৎপর্য কোথায়? দু-চার লাইন
জন্ম দিলে কেমন যেন একটা আলগা তৃপ্তি জুড়ে থাকে আপামর বাঙালির।
বৃষ্টি, কাব্য----
টাগ অফ ওয়ারে আরও একটি বিষয় ঝুলিতে চলে আসে। ‘খাদ্য’। কবিতাই কিন্তু মধ্যমণি। প্ল্যানচেটের মিডিয়িটরের মতো। বর্ষা আর খিদের মধ্যে দুর্দান্ত সংযোগ স্থাপন
করে চলেছে। তাই তো
কেমন কাব্য-র ‘য’ফলা আর
খাদ্য-র ‘য’ফলা বাঙালির ‘অঙ্গে
ধরিছে জড়ায়ে’ মনে হয়। সমস্ত প্রদেশ, বিদেশের সব রেসিপিই
বাঙালি ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ আরও অনন্য
করে তুলেছে। ভরা বাদরে
চটপটা মোগলাই খানার আদর ফ্রিজারে নয়, উদরে জমলে... সারা
জমানা খুশ।
‘মুর্গ
ইয়াখনি’। মুঘল
কীর্তি। কাশ্মীরিদের পছন্দের
খাদ্য। শুধুমাত্র ইয়াখনি
বিষয়টিই বেশ গভীর এবং তার বৈচিত্র্যও অনেক। ‘মুর্গ
ইয়াখনি’, ‘ইয়াখনি পোলাও’ ইত্যাদি। মুর্শিদাবাদের নবাবদের নাকি খুব প্রিয় খাবার
ছিল মুর্গ ইয়াখনি। তবে সেই
ইয়াখনির মোরগ আজ বললেই কাল রান্না হত না। সময় লাগত
কয়েক দিন। সদ্য
যুবক হওয়া একটি মোরগকে আটার মধ্যে বিষ মিশিয়ে খাওয়ানো হত। মোরগটি মারা গেলে তার শরীর থেকে সামান্য মাংস কেটে আবার আটায়
মিশিয়ে খাওয়ানো হত অন্য আরেকটি মোরগকে। শেষে
এই বিষ খেয়ে যে মোরগের শুধু পালক খসে পড়ত সেই একমাত্র যোগ্য ছিল ইয়াখনির জন্য। প্রণালীটি নির্মম হলেও এই মাংসই একমাত্র সুস্বাদু
হত।
অথেন্টিক
ইয়াখনির এত গভীরতায় ডুব না দিয়ে কম সময়ে ঘরোয়া ইয়াখনি বানাতে কী কী উপকরণ লাগবে দেখে
নিই।
রেসিপি: মুর্গ ইয়াখনি
চিকেন- ৭০০ গ্রাম
সরষের তেল- ৪ চামচ
মৌরির গুঁড়ো- ১ চা চামচ
ক্রাশড গোটা গোলমরিচ- ১ চা
চামচ
আদা বাটা- ১ চা চামচ
ক্রাশড শুকনো পুদিনা পাতা- ১ চা
চামচ
লবঙ্গ, দারচিনি, ছোট এলাচ, বড় এলাচ, জায়ফল, জয়িত্রী- ২টো করে
টক দই- ৪০০ গ্রাম
পিঁয়াজ- মাঝারি সাইজ একটা
কুচি করে কাটা
রসুন- তিন কোয়া কুচি করে
কাটা
নুন- স্বাদমতো
প্রণালী:
একটা পাত্রে নুন, মৌরি গুঁড়ো, ক্রাশড
গোল মরিচ ও আদা বাটা দিয়ে চিকেনটাকে আধ ঘণ্টা ম্যারিনেট করে রাখতে হবে। ম্যারিনেট হলে প্যানে তিন চামচ সরষের তেল
গরম করে চিকেনটা কম আঁচে রান্না করতে হবে। এখানে
বলে রাখা ভালো যেহেতু কাশ্মিরীরা সরষের তেল বেশি ব্যবহার করে তাই এখানেও সরষের তেলই
নেওয়া হয়েছে। কারো
অসুবিধে থাকলে সাদা তেল বা মাখনেও করতে পারেন।
অন্য
একটি ওভেনে আরেকটি প্যান গরম করে তাতে মিক্সিতে ব্লেন্ড করা টক দই ঢেলে সমানে হাতা
বা স্প্যাচুলা দিয়ে নাড়তে হবে যাতে লেগে না যায়। সামান্য ফুটে উঠলে সমস্ত গরম মশলা, পিঁয়াজ, রসুন
কুচি দিয়ে লো আঁচে খানিকক্ষণ ফোটাতে হবে, যাতে প্রতিটি মশলার
রস ভালোভাবে দইতে মিশে যায়। মিশ্রণটি
তৈরি হয়ে গেলে তাতে এক চামচ সর্ষের তেল মেশাতে হবে। দইয়ের মিশ্রণটি যেন খুব ঘন বা খুব পাতলা না হয়। প্রয়োজন পড়লে সামান্য জল মেশাতে পারেন।
চিকেন
কম আঁচে প্রায় পঁচিশ মিনিট ধরে রান্না করতে হবে, জল চিকেন
থেকেই বেরোবে। বাইরের
জল অ্যাড করার প্রয়োজন নেই। চিকেন
সেদ্ধ হয়ে গেলে রান্না হওয়া দইটি ছাঁকনির সাহায্যে চিকেনে ঢেলে দিতে হবে যাতে বাকি
মশলার রসটুকুই শুধু যাবে। ভালোভাবে
মিশে গেলে ক্রাশড পুদিনা পাতা ছড়িয়ে দিতে হবে। ইয়াখনিতে নাকি এই পুদিনা গুঁড়োই আসল ধারক ও বাহক। পাতা শুকিয়ে হাতে ক্রাশড করে নেওয়া যায়। নামাবার আগে সামান্য মিষ্টি আর এক চামচ মাখন
যোগ করতে পারেন স্বাদের জন্য, যদিও আমি উপকরণে
রাখিনি।
ভাতের চেয়ে রুটি বা পরোটাতেই জমে যাবে মুর্গ ইয়াখনি। কী বললেন? কবিতা
লেখেন না? না না, দোষ নেই
কোনো। বৃষ্টির তালে তালে ‘বুমরো
বুমরো’ ছন্দে চোখ বুজে মুখে চালান করে দিন পরোটার
ভাঁজে মুর্গ ইয়াখনি। এমনও
বাদরে, ইয়াখনির আদরে, আদপে
আপনিও রোম্যান্টিক বাঙালি প্রমাণিত হবেন।
Recent Comments: