স্বপ্ন উড়ান
পর্ব: ৭
২০১৫
সাল। উইংস্যুট ফ্লাইংয়ের ইতিহাসে এই বছরটা দুর্ভাগ্যজনক বলে লেখা থাকবে। কত কত প্রতিভাবান
যুবক যে এই বছর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে, সেটা দেখলে নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে।
অথচ
বছরটা খারাপ হওয়ার কথা ছিল না। সেড্রিক ডুমন্ট আর নোয়াহ বানসন গিজা পিরামিডের ওপর দিয়ে
উইংস্যুট ফ্লাইং করে রেকর্ড করেছে, ভিনসে রেফেটরা দুবাইতে ‘মোটোরাইজড জেটউইং’-এর সাহায্য
নিয়ে ‘ডায়নামিক উইং ফর্মেশন’ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে, ‘বিগেস্ট উইংস্যুট ফর্মেশন’-এর
রেকর্ড ভাঙা হয়েছে দু’ বার।
মে মাস। আমেরিকার ইয়োসেমাইট ন্যাশনাল পার্কের ‘Taft Point’-এর ওপর থেকে বেসজাম্প করার জন্যে তৈরি হচ্ছিলেন ডিন পটার ও গ্রাহাম হান্ট। ডিন নামকরা ক্লাইম্বার এবং ফ্রি সোলোইস্ট, পাশাপাশি উইংস্যুট ফ্লাইং ও হাইলাইনার হিসেবেও বহুদিন ধরে পরিচিত। হান্টও একাধিক স্পোর্টসে হাত পাকিয়েছেন। এই জুটি বেশ কয়েক বছর ধরে ইয়োসেমাইট অঞ্চলে ফ্রি সোলো করেছে, তাছাড়া অন্যান্য জায়গায় ফ্লাইও করেছে। একাধিক স্পোর্টসে যুক্ত হওয়ার ফলে পটারের বন্ধুবৃত্ত বেশ দীর্ঘ। ফ্রি সোলোইস্ট অ্যালেক্স হোনাল্ড এবং হাইলাইনার নাথান পাউলিনের সঙ্গে যেমন সখ্য আছে পটারের, একইসঙ্গে সোমার আর করলিসদের সঙ্গেও তাদের ভাব আছে দিব্যি। এছাড়াও পটার দম্পতি এবং গ্রাহাম হান্ট আমেরিকার ‘নোমাড লাইফ’-এর প্রবল সমর্থক, নিরাপদ জীবনের হাতছানি তাদের কোনোদিনই ঘরে বেঁধে রাখতে পারেনি। সারা জীবন ধরে তারা বনে, পর্বতে, অরণ্যে, আকাশে অ্যাড্রেনালিন রাশের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছে। অর্থের অভাব এবং বয়সের কাঁটা তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি।
ইয়োসেমাইট
অঞ্চলের এই জাম্পের পরিকল্পনাও তাদের দুঃসাহসিক মনের পরিচয় বহন করে। তার একটা কারণ,
সরকারের পক্ষ থেকে এই অঞ্চলে উইংস্যুট ফ্লাইংয়ের অনুমতি দেওয়া হয় না বিপদের আশঙ্কায়।
কিন্তু বিপদের ভয় দেখিয়ে পটার-হান্ট জুটিদের বেঁধে রাখা সম্ভব নয়, সেটা সকলেই জানে।
প্রতি বছর বেআইনি ভাবে বেশ কয়েক জন উইংস্যুট ফ্লাইয়ার এই অঞ্চলে ফ্লাইং করতে বদ্ধপরিকর
থাকে।
জাম্প
হয়েছিল পরিকল্পনা মতোই। তাদের ল্যান্ডিংয়ের জন্যে রেডিওতে কান পেতে অপেক্ষা করেছিল
স্পটার, বছর কুড়ির এক তরুণী। কিন্তু আচমকাই একটা অভিঘাতের শব্দ কানে আসে, এরপর রেডিও
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্পটার দেরি না করে যোগাযোগ করে ডিন পটারের স্ত্রীর সঙ্গে।
পার্কের রেসকিউ দপ্তর অনুসন্ধান শুরু করে সত্বর, সঙ্গে নেওয়া হয় পটার দম্পতির বিশ্বাসী
কুকুর ‘হুইসপার’কেও।
মৃতদেহ দুটো পেতে দেরি হয়নি। কোনো কারণে পটার আর হান্ট দুজনেই ঠিক সময়ে প্যারাস্যুট ডেপ্লয় করতে পারেনি, ফলে দুজনেই ধাক্কা খেয়েছিল ইয়োসেমাইটের পাথরের দেওয়ালে। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে হয়নি তাদের।
এই ঘটনার পর বিষাদের ছায়া নেমে আসে এক্সট্রিম স্পোর্টসের দুনিয়ায়। ডিন পটারের চলে যাওয়া স্বীকার করা সহজ হয়নি। উইংস্যুট ফ্লাইংয়ের পাশাপাশি ক্লাইম্বিং আর হাইলাইনিং জগতের লোকজনও বিমর্ষ হয়ে ওঠে এই খবর পেয়ে।
কে জানত,
এটাই শেষ নয়! ২০১৫ উইংস্যুট ফ্লাইং জগতের সবচেয়ে বড় তারকাকে গিলে নিতে চলেছে?
জুলাই
মাসের চার তারিখ। সোমার তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠল। ঘুমজড়ানো
চোখে ফোন তুলে ধরতেই একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সোমার।
“হ্যালো
সোমার! আমি পেড্রো। পেড্রো তোসিন।”
কয়েক
মুহূর্ত সময় লাগল মাথাটা পরিষ্কার হতে। পেড্রো তো জোনাথন ফ্লোরেজের সহকারী, তার যাবতীয়
পরিকল্পনা দেখাশোনা করে সেইই। আগেও কথা হয়েছে তাদের। দু’ একদিন আগেই জনির সঙ্গে কথা
হয়েছে, সে এখন সুইট্জারল্যান্ডের এঙ্গেলবার্গে ফ্লাইংয়ের জন্যে নতুন বেস খুঁজে বেড়াচ্ছে।
কাজ হয়ে গেছে তবে? নিশ্চয়ই সোমারের সঙ্গে দেখা করতে চায় সে! আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল
সোমারের মন। অনেকদিন পর দেখা হবে জনির সঙ্গে।
ফোন কানে
চেপে ধরে সোমার বলল, “হ্যাঁ পেড্রো! বলো কী খবর? দেখা হবে নাকি আমাদের?”
পেড্রো
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “সোমার, জনি ইজ গন।”
পরবর্তী
কয়েক মুহূর্ত হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সোমার। পেড্রো আরো কীসব বলে যাচ্ছে, সেই সব
ঠিক করে তার মাথায় ঢুকছে না। জোনাথন ফ্লোরেজ, আকাশই যার আসল আস্তানা, যাকে বার্ডম্যান
বলে ঠাট্টা করা হয়---- সে কি উইংস্যুট ফ্লাইং করতে গিয়ে মারা পড়তে পারে? সেটা হতেই
পারে না।
“সোমার,
সোমার! আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?”
পেড্রোর
কথায় সংবিৎ ফিরল সোমারের। ধরা গলায় উত্তর দিল পেড্রোকে। অস্ফুট স্বরে বলল, “কী করে
হল?”
পেড্রো
আস্তে আস্তে বলল, “ফ্লাইং করতে গিয়ে হয়নি। আসলে কী হয়েছিল বোঝা যাচ্ছে না। হাইকিং করে
কোনো অজানা ক্লিফ খুঁজছিল সে বেস করার জন্যে। খুব সম্ভবত পা পিছলে পড়ে গিয়েছে সেখান
থেকে! কিন্তু ঠিক করে বলা যাচ্ছে না।”
সোমার
ফোন রেখে বসে রইল অনেকক্ষণ। বন্ধুর চেয়েও অনেক বেশি
গভীর
সম্পর্ক ছিল জনির সঙ্গে, ছোট ভাইয়ের মতোই আগলে রাখত তাকে সে। আবার একসঙ্গে দস্যিপনা
করতেও তাদের উৎসাহ কম ছিল না। কতবার একসঙ্গে জাম্প করেছে, কত রেকর্ড করেছে উইংস্যুট
ফর্মেশনের, কত কত রেকর্ড আছে জনির নামে---- সে কিনা পা পিছলে পড়ে মারা গেল? কিছুতেই
এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না সে।
দিন
কাটতে না কাটতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় উইংস্যুট ফ্লাইয়ারদের মেসেজ আসতে শুরু করল ফ্লোরেজের
উদ্দেশ্যে। সোমার হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল। কী লিখবে সে? এতগুলো বছর, এতগুলো মুহূর্ত!
স্মৃতির আয়নায় পরপর ফুটে উঠছে জনির অনাবিল হাসিমাখা মুখটা! সেটা কয়েক লাইনে লেখা সম্ভব!
চেষ্টা করেও কয়েক লাইনের বেশি লিখতে পারল না সে।
Jonathon Florej! I will never forget
you brother! Flying will never be the same now that you bailed on us : ( Being
on a trip with you was always painful after a while, but that was only because
you made us laugh too much... Im deeply thankful that we got to share so many
funny moments and crazy adventures together. Im happy I got to be a part of
your life and watching you succeed on making your biggest dreams come true...
Everything from marrying your beautiful wife Kaci to becoming the best flyer in
the world, signing with Red Bull, winning championships and shooting Hollywood
films... You made it all and you were winning at life! You inspired all of us
with your unique way of being, life loving personality and positivity! It
brakes my heart to accept there won`t be anymore Jhonny love in reality, but
the smiles and memories will always be a part of me <3
Thanks for being you and for
everything you brought into our lifes Jhonny! I love you bro and I will deeply
miss your spirit in the sky…
কয়েক
দিনের মধ্যেই সোমার বুঝতে পারল, তার আত্মবিশ্বাসে আঘাত লেগেছে। জনির মৃত্যুর পর সবসময়
তার মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ক্লিফের ওপর দাঁড়িয়ে জাম্প দেওয়ার সময় সে আর আগের
মতো উদাসীন থাকতে পারবে না। একটা অজানা ভয় বা বলা ভালো জীবনের মায়া তাকে জড়িয়ে ধরেছে।
প্রিয় বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে বিচ্ছেদের এই অনুভূতি কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। এই
অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে তাকে নিজের সঙ্গেই লড়াই করতে হবে, করে যেতে হবে যতক্ষণ
না আবার সে স্বচ্ছন্দ হতে পারছে!
অনেক
ভেবেচিন্তে সোমার ঠিক করল, তাকে সুইট্জারল্যান্ডেই যেতে হবে। সেই জায়গায়, যেখানে প্রথম
সে মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখেছিল! সেই জায়গায়, যেখানে জনি শেষ ফ্লাই করেছে। ভয় ভাঙানোর
একমাত্র উপায়, তার সামনাসমনি গিয়ে দাঁড়ানো। ভয়ই তাকে পথ দেখাবে এগিয়ে যাওয়ার!
Recent Comments: