পর্ব: ৬
৫ জুন, ২০১৭: দুপুরে খেলাম টুনা স্যালাড, মটরশুঁটি আর গাজর সহযোগে পর্ক কাটলেট, ফ্যান্টা আর ক্যারামেল সস দেওয়া একটা পুডিং। এই প্রথম আমি ক্যারামেল সস খেলাম, খেতে অনেকটাই আমাদের দিশি নলেন গুড়ের মতো।
খাওয়ার পরে আর ক্লাস নেই, সবাই মেট্রো চড়ে গেলাম সিটি
সেন্টারে। ইউনিভার্সিটির ভেতর দিয়েই মেট্রোর লাইন গেছে ওভার ব্রিজের ওপর দিয়ে। দুই
কামরার ছোট্ট ট্রেন, আর প্রায় সবাই বসার জায়গা পেয়ে গেল। আমি
সামনের কামরায় উঠে ছিলাম, সামনের দিকে গিয়ে দেখি ড্রাইভারের
কেবিন নেই! কী কাণ্ড! চালকবিহীন রোবোটিক ট্রেন! গা বেশ ছমছম করে উঠল। সামনের দিকটা
কাচ দিয়ে ঢাকা বলে সামনের দৃশ্যের ভিডিও পুরোটাই মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করতে
পারলাম। বেশ থ্রিলিং অভিজ্ঞতা হল হাই স্পিডে রেললাইন বেয়ে ঢালু পথে নেমে একেবারে
আন্ডারগ্রাউন্ডে ঢুকতে। সিটি সেন্টার মেট্রো স্টেশন আন্ডারগ্রাউন্ডে।
মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমরা সবাই হাজির
হলাম ট্যুরিজম অফিসের সামনে। অফিস থেকে একজন সুন্দরী ফরাসি মহিলাকে আমাদের সঙ্গে
দেওয়া হল সিটি ট্যুর গাইড হিসেবে। তিনি বেশ ঝরঝরে ইংরেজি বলতে পারেন। সব ইওরোপীয়
শহরের মতোই লিলেও একটি চত্বরকে ঘিরে প্রশাসনিক প্রাসাদগুলি অবস্থিত। এই চত্বরকে
বাকি সব ইওরোপীয় শহরে যেমন,
এখানেও বলা হয় সেন্ট্রাল স্কোয়ার। স্কোয়ার ঘিরে রয়েছে পুরোনো ও নতুন
চেম্বার অফ কমার্স, অপেরা হাউস, মিউনিসিপালিটি
হাউস ইত্যাদি। স্কোয়ারের মাঝখানে রয়েছে একটি লম্বা ওয়ার মেমোরিয়াল। যেহেতু লিল
শহরটি ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের সীমান্তে অবস্থিত, প্রাসাদগুলির
স্থাপত্যে ফরাসি ও বেলজিয়ান দুই রকম শিল্পের মিশ্রণ রয়েছে। গাইড ভালো করে ব্যাখ্যা
করলেন কোন অংশটা ফরাসি স্থাপত্যের আর কোন অংশটা বেলজিয়ান স্থাপত্যের নিদর্শন। আমি
লেকচার কম শুনলাম, ছবি তুললাম বেশি।
বেশ কিছুক্ষণ পর সিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে একটা পাথুরে গলির মধ্যে দিয়ে হেঁটে আমরা এসে হাজির হলাম একটা ঘাসে ঢাকা খোলা মাঠে। সবাই সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে-বসে বিকেলের রোদ পোয়াচ্ছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বসা গেল মাঠে হাত-পা ছড়িয়ে। তারপর সেখান থেকে উঠে আবার একটা পাথুরে গলি দিয়ে হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম একটা বিশাল গথিক চার্চের পিছনের দিকে। এই পাথুরে গলিগুলো হল পদযাত্রীদের জন্য শর্টকাট। গাড়ি নিয়ে ঘুরলে পিচ ঢালা বড় বড় রাস্তা দিয়ে ঘুর পথে চার্চের সামনে আসা যেত। পাথুরে গলিতে হিল তোলা জুতো পরে খুব সাবধানে হাঁটতে হল। দুটো পাথরের মাঝখানের খাঁজে হিল আটকালেই উলটে যেতে হবে। আকবর হাসতে হাসতে বলল “স্নিকার পেহেনকে আনা চাহিয়ে থা না!” বললাম, “পতা নহিন থা না রাস্তা অ্যায়সে হোঙ্গে।”
যাক বেশিক্ষণ আর হাঁটতে হল না, একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম
আমরা কনফারেন্স ডিনার খাব বলে। আহা! কী কী খেলাম বলতেই হবে। হোয়াইট ওয়াইনের সঙ্গে
প্রথমেই দিলো ফ গ্রা--- হাঁসের মেটে, একটা ফরাসি ডেলিকেসি, সে যে কী ভালো খেতে!
মুখে দিলেই গলে যাচ্ছে! তারপর খেলাম লোতে অ ব্যুরে ব্লাঁ---- মাছ দিয়ে পাস্তা,
হোয়াইট সস দেওয়া। শেষে খেলাম চকোলেট সস দেওয়া ব্রাউনি! উফ! স্বর্গীয়
স্বাদ!
খাওয়াদাওয়া সেরে আবার মেট্রো করে
ইউনিভার্সিটি ফিরে এলাম সবাই। তখন বেজে গেছে রাত দশটা। একজন ম্যাম আমায় জিজ্ঞাসা
করলেন আমি কোথায় থাকছি। বললাম ওভার ব্রিজ পেরিয়ে হেঁটে যাই। উনি বললেন এত রাতে আর
হেঁটে না যাওয়াই ভালো,
উনি আমায় গাড়ি করে পৌঁছে দেবেন। আমার সঙ্গে যে চিনে মেয়েটা থাকে সে
বাকি চিনেদের সঙ্গে ভিড়ে সিটি সেন্টারেই আছে। নাইট পাবে যাবে হয়তো। ইনের সামনে
ম্যাম যখন আমায় ওঁর গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলেন তখন বেজে গেছে রাত এগারোটা। এতদিনে আমি
লিলের অন্ধকার আকাশ দেখতে পেলাম। এই দিন আর জানলার পর্দা টানলাম না, নইলে এর আগে প্রতি রাতে আমি ন’টা নাগাদ শুয়ে পড়েছি
জানলার ভারি পর্দা টেনে বাইরের আলো আসা বন্ধ করে। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুম
এসে গেল চোখে হাঁটার ক্লান্তিতে ও ফরাসি ওয়াইনের মাদকতায়।
Recent Comments:
শ্রীময়ী চট্টোপাধ্যায়। 2021-04-12
Detailing enjoy korchhi. Tomar sathe tomar chokhe amio France ghurchhi.