স্কুলজীবনে গণিত বইয়ে আমরা সকলেই পড়ে এসেছি জ্যামিতি।
হরেক রকম উপপাদ্য-সম্পাদ্য বা কম্পাস দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটার সময় আমাদের হয়তো
অনেকেরই মাথায় এসেছে যে আমরা জ্যামিতিতে ঠিক কী করছি, কেনই বা করছি। খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে এক মহান গণিতজ্ঞ
এই জ্যামিতিকে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছিলেন,
যাঁকে ‘ফাদার অব্ জিওমেট্রি’
বলা হয়।
গণিতের বিভিন্ন শাখা যেমন জ্যামিতি, গাণিতিক রাশি, গাণিতিক সংকেত,
সংখ্যাতত্ত্বের
ওপর প্রচুর কাজ রয়েছে।
ইউক্লিডের জন্ম সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য তেমন
কিছু নেই। গ্রিসের হেলেনিস্টিক যুগে তাঁর জন্ম ও কর্মজীবন অতিবাহিত হয়। অনুমান করা
হয় খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৩০০ বছর আগে তিনি জন্মগ্রহণ করেন গ্রিসে। তিনি প্লেটোর
বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। পরবর্তী সময়ে সেটি স্থানান্তরিত হয় আলেকজান্দ্রিয়া।
হেলেনিস্টিক যুগে আলেকজান্দ্রিয়া ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। আলেকজান্দ্রিয়া
গ্রন্থাগার ছিল শিক্ষাচর্চার জন্য বিশ্ববিখ্যাত এক স্থান। ইউক্লিড এই
গ্রন্থাগারেই নিজের পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন।
ইউক্লিডের গণিত ছিল বেশিরভাগটাই জ্যামিতিক বীজগণিত। তাঁর রচিত অনেক বই বা কাজেরই সন্ধান মেলেনি। তাঁর তিনটি বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়---- ‘এলিমেন্ট’, ‘ডাটা’, ‘অপটিক্স’।
তবে তিনি যে কাজের জন্য সর্ববিখ্যাত সেটি হল ‘ইউক্লিডস্ এলিমেন্টস’
গ্রন্থটি।
এটি প্রথমে আরবি ভাষা ও পরে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়। সর্বমোট ১৩টি খণ্ডে
প্রকাশ পেয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে
ইউক্লিডিয় জ্যামিতি ও প্রাচীন গ্রিক সংখ্যাতত্ত্বের বহু মূল্যবান উপাদান। জ্যামিতিকে
সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে বিচার করার মূল কারণ সম্ভবত তৎকালীন সময়ে পাটিগণিতের খুব বেশি
উন্নতি না হওয়া। জ্যামিতি শাস্ত্রের বিভিন্ন স্বীকার্য, স্বতঃসিদ্ধ ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ এই বইটির জনপ্রিয়তার মূল কারণ
হল প্রতিটি তত্ত্বের পেছনে সুস্পষ্ট যুক্তি,
যা
তৎকালীন সমাজে গাণিতিক যুক্তিবাদ চর্চার প্রসারকেই চিহ্নিত করে। ছাপাখানা আবিষ্কার
হওয়ার প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল এই ‘এলিমেন্টস’। এটি প্রায় ১০০০ এর বেশি বার মুদ্রিত হয়, যেই মুদ্রণ সংখ্যাটি
ছিল বাইবেলের ঠিক পরেই। প্রায় দু’ হাজার বছর ধরে বইটি জ্যামিতির মূলভিত্তি হিসেবে
বিবেচিত হয়ে এসেছে।
এই গ্রন্থের প্রথমেই ইউক্লিড তল, রেখা, বিন্দু সম্পর্কে
সংজ্ঞা ও ধারণা দিতে চেয়েছেন।
১) যার কোনো অংশ নেই, সেটিই হল বিন্দু।
২) রেখার প্রান্ত বিন্দু নেই।
৩) যার দৈর্ঘ্য আছে কিন্তু প্রস্থ বা উচ্চতা নেই, তাই হল রেখা।
৪) যার শুধুমাত্র দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে, তাই তল।
৫) তলের প্রান্ত হল রেখা
তবে এই সংজ্ঞাগুলোর জন্য কিছু প্রাথমিক ধারণা
স্বীকার করে নিতে হয়, যেগুলো স্বতঃসিদ্ধ বা
Axiom নামে পরিচিত। যেমন:
১) যে সকল বস্তু একই বস্তুর সমান, সেগুলো পরস্পর সমান।
২) সমান সমান অংশের সঙ্গে সমান অংশ যোগ বা বিয়োগ
করা হলে সেই যোগফল বা বিয়োগফল সমান।
৩) যে সমস্ত বস্তু একে অপরের ওপর সমাপতিত হয়, তারা পরস্পর সমান।
৪) সম্পূর্ণ বস্তুটি তার কোনো অংশের চেয়ে
বৃহত্তর।
জ্যামিতিতে বিন্দু, তল ও রেখার কিছু বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করে নেওয়া হয় এবং
পরবর্তী জ্যামিতির মূল ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলোকে বলা হয় স্বীকার্য বা Postulate. ইউক্লিড প্রদত্ত বিখ্যাত পাঁচটি স্বীকার্য ছিল:
১) যে কোনো দুটি বিন্দুর সংযোগ থেকে একটি সরলরেখা
অঙ্কন করা যাবে।
২)
রেখাংশকে যথেচ্ছভাবে বর্ধিত করা যাবে।
৩) যে কোনো কেন্দ্র ও ব্যাসার্ধের বৃত্ত অঙ্কন
সম্ভব।
৪) সকল সমকোণ সমাপতিত হয়।
৫) একটি সরলরেখা আরো দুটি রেখাকে ছেদ করলে
একপাশের অন্তঃস্থ কোণদ্বয়ের সমষ্টি দুই সমকোণের কম হলে, রেখা দুটিকে বর্ধিত করলে, যেদিকে কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের কম,
সেই দিকে
মিলিত হয়।
এইভা বে ধাপে ধাপে ইউক্লিড সংজ্ঞা, স্বীকার্য ও স্বতঃসিদ্ধের মাধ্যমে বিভিন্ন জ্যামিতিক প্রতিজ্ঞা স্থাপিত করেন।
তবে এই জ্যামিতিই ‘প্রমাণ’ নয়। এই জ্যামিতি
বিশেষ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যেটিকে গাণিতিক
পরিভাষায় বলা হয় ‘ইউক্লিডিয়ান স্পেস’। উনবিংশ
শতাব্দীতে নতুন ধরনের জ্যামিতি আবিষ্কৃত হয়,
যেগুলোতে
ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি ভেঙে পড়ে। এ ধরনের জ্যামিতিকে নন্-ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি
বলা হয়। আইনস্টাইনের বিখ্যাত সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ এই অ-ইউক্লিডিয় জ্যামিতির
ওপরই প্রতিষ্ঠিত।
দুটি সংখ্যার গসাগু নেওয়া হলে, বৃহত্তর সংখ্যা থেকে ক্ষুদ্রতর সংখ্যাটি বিয়োগ করার পরও
সেই গসাগু অপরিবর্তিত থাকে---- এটি ইউক্লিডীয় অ্যালগরিদম নামে পরিচিত।
ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস্’ মূলত একটি সংকলন। এই জ্যামিতির বেশ কিছু জিনিসই ভারত ও আরব
দেশে প্রচলন ছিল, তবুও সর্বজনীন ভাবে
লিখিত ও গোছানো আকারে জ্যামিতির প্রথম বই এটি। সংকলন হলেও এই বইয়ে ইউক্লিডের
প্রতিভার মৌলিকত্ব হ্রাস পায় না। মানবসভ্যতার ইতিহাসে চিন্তা ও দর্শনের
সর্বশ্রেষ্ঠ বইগুলোর মধ্যে এটি একটি। পরবর্তী সময়ে রিম্যান, আইনস্টাইনের মতো বৈজ্ঞানিক এই জ্যামিতির ওপর কাজ করে
বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন।
আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত দার্শনিক টলেমি জানতে চেয়েছিলেন যে এলিমেন্টস্ অধ্যয়ন ব্যতীত জ্যামিতি চর্চার আর কোনো সহজ উপায় রয়েছে কিনা। ইউক্লিড উত্তর দিয়েছিলেন "There is no royal road to geometry"
Recent Comments: